✍️ লেখক: ইঞ্জিনিয়ার শফিক ইসলাম (রাজনৈতিক বিশ্লেষক)
ড. মুহাম্মদ ইউনুস যখন জোরপূর্বক বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, এটি শুধু
অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক ঘটনা ছিল না—বরং ছিল এক পরিকল্পিত ইসলামপন্থী পুনরুত্থানের সূচনা।
শুরু থেকেই ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছিল যে এই সরকার জঙ্গিবাদী উপাদানকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেবে।
কারণ ইউনুস ক্ষমতায় এসেছেন সেই রাজনৈতিক মহল ও নেটওয়ার্কের সমর্থনে, যারা বহু বছর ধরে উগ্র
ইসলামপন্থার সঙ্গে জড়িত।
মুফতি রহমানীর মুক্তি: জঙ্গি তুষ্টির প্রথম সংকেত
ইউনুস ক্ষমতায় আসার মাত্র ১৬ দিনের মাথায়, নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের
(এবিটি) প্রধান মতাদর্শী মুফতি জাসিমউদ্দিন রহমানী জামিনে মুক্তি পান। আল-কায়েদার প্রচারক
আনোয়ার আল-আওলাকির অনুসারী রহমানী ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার হত্যায় প্ররোচনার দায়ে
দণ্ডপ্রাপ্ত।
তার মুক্তির পরপরই একটি উসকানিমূলক ভিডিও প্রকাশিত হয়, যেখানে ভারতের বিভাজন এবং দিল্লিতে
ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়। রাষ্ট্রের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এটি কোনো
ত্রুটি ছিল না—এটি ছিল সবুজ সংকেত।
সমন্বিত কারাগার ভাঙা: জঙ্গিদের সঙ্গে পরিকল্পিত যোগসাজশ
এরপরের কয়েক মাসে নরসিংদী, শেরপুর, সাতক্ষীরা ও কুষ্টিয়ার উচ্চ-নিরাপত্তা কারাগার থেকে
ধারাবাহিকভাবে জঙ্গিদের নাটকীয় পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। ২,২০০-এর বেশি বন্দি, যাদের মধ্যে এবিটি
ও জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) সদস্যও ছিল, দিনের আলোয় পালিয়ে যায়।
প্রতিবেদনগুলো বলছে, কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল নির্দিষ্ট ইসলামপন্থী বন্দিদের
অগ্রাধিকার দিয়ে মুক্তি দেওয়ার জন্য। এরা কোনো নিরাপত্তা ঘাটতি ছিল না, বরং পরিকল্পিত সহায়তা।
এক বন্দি ব্যবসায়ী রফিকুল আমিন প্রকাশ করেন যে কারা কর্মকর্তারা হরকতুল জিহাদ ও
আনসারুল্লাহর সদস্যদের মুক্তিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছিলেন। অন্য বন্দিদের কোনো সুযোগ ছিল না। এই
নীতি স্পষ্ট করে দেয়—সরকারের সহানুভূতি জঙ্গিদের প্রতিই।
নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের প্রত্যাবর্তন
দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ থাকা হিযবুত তাহরীর আবার প্রকাশ্যে সক্রিয় হয়েছে। ৭ মার্চ ২০২৫-এ ঢাকায় হাজারো
কর্মী প্রকাশ্যে খেলাফতের দাবিতে মিছিল করে। পুলিশ নীরব দর্শক ছিল—কখনও সহানুভূতিও দেখিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ ও কক্সবাজারেও একই ধরনের সমাবেশ হয়েছে। এ ধরনের নিষিদ্ধ সংগঠন সরকারের শীর্ষ
অনুমতি ছাড়া রাস্তায় নামতে পারে না।
জঙ্গিদের আইনি সাদা দাগ
ইউনুস সরকার শুধু চোখ বুজেই থাকেনি, বরং জঙ্গিদের অপরাধ মুছে দেওয়ার কাজও করেছে।
আনসার আল-ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান মেজর জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করা
হয়েছে।
১৩ মে ২০২৫-এ রমনা বটমূলে বোমা হামলার দণ্ডপ্রাপ্তদের সাজা হ্রাস করা হয়েছে।
আদালত এখন জঙ্গি অপরাধ ধোয়ার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থন
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার সাজ্জাত আলীর ঘোষণা—“বাংলাদেশে কোনো জঙ্গি নেই”—দশকের
পর দশক ধরে সন্ত্রাসী হামলার শিকারদের ব্যথাকে তুচ্ছ করে।
একই সময়ে হেফাজতে ইসলামের নেতা মুফতি হারুন ইযহার, যার বিরুদ্ধে ২৬টি মামলা আছে, তাকে
সরকারের আইন উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক ও পুলিশের ব্রিফিং নিতে দেখা গেছে। এটি নিরপেক্ষতা নয়—এটি
রাষ্ট্রপৃষ্ঠপোষক জঙ্গিবাদ।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পুনর্লিখন
২০০৪ সালে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে চালানো গ্রেনেড হামলার মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত সকল আসামিকে
ডিসেম্বর ২০২৪-এ খালাস দেওয়া হয়। সাবেক প্রতিমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু ও লুৎফুজ্জামান বাবর
মুক্তি পান। এটি কোনো আইনি রায় নয়, বরং এক রাজনৈতিক বার্তা: ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের শত্রুরা
আর রাষ্ট্রের শত্রু নয়।
জনসমক্ষে জঙ্গি পতাকা
ঢাকার রাস্তায় আবারও ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর পতাকা উড়তে দেখা গেছে। কালেমাখচিত কালো
পতাকা সামরিক কনভয়ের সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে। এটি আর প্রান্তিক নয়—এটি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ, যা
সরকারের নীরব সমর্থনে সম্ভব হয়েছে।
বিতর্কিত নিয়োগ: ছায়া থেকে সিটি কর্পোরেশনে
সবচেয়ে আলোচিত উদাহরণ হলো মোহাম্মদ ইজাজকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক হিসেবে
নিয়োগ। অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খানের দাবি, তিনি শুধু ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রাক্তন
সদস্যই নন, বরং নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীরের সিনিয়র নেতা।
অভিযোগ আছে, তিনি আগে গোপনে সক্রিয় থাকলেও ইউনুস সরকারের আমলে পুনর্বাসিত ও প্রভাবশালী
পদে বসানো হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত তথাকথিত “ছোটন গ্যাং” নামের এক নেটওয়ার্ক, যেখানে
প্রযুক্তিবিদ ও মতাদর্শীরা গোপনে সরকারের ভেতরে ইসলামপন্থী প্রভাব বিস্তার করছে।
মাহফুজ আলম ও ইসলামপন্থী উপদেষ্টাদের উত্থান
অস্থায়ী সরকারের নীতিনির্ধারক উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। অভিযোগ আছে,
তিনি দীর্ঘদিন ইসলামপন্থী এনজিওর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যারা অতীতে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে অর্থায়ন
করেছে। যদিও তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক মামলা নেই, সরকারের নীরবতা জনমনে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
গুম কমিশন ও সত্য গোপনের আশঙ্কা
অস্থায়ী সরকারের ঘোষিত “গুম কমিশন” প্রথমে প্রশংসা পেয়েছিল। কিন্তু সদস্যদের মতাদর্শিক
ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ আছে, কমিশনটি নিরপেক্ষ তদন্তের বদলে ইসলামপন্থীদের
অপরাধ ধোয়ার হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান থেমে যাওয়া
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান মিলিট্যান্ট নেটওয়ার্ককে চাপে রেখেছিল।
কিন্তু ইউনুস সরকার আসার পর এসব অভিযান হঠাৎই থেমে গেছে। সিটিটিসি কর্মকর্তারা বলছেন,
রাজনৈতিক সমর্থনের অভাব ও আমলাতান্ত্রিক বাধার কারণে তারা কার্যত অচল।
এমনকি হলি আর্টিজান হামলার মতো মামলায়ও বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন
এটি ইচ্ছাকৃত বিলম্ব, যাতে আসামিরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি পায়।
সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকর্তাদের শুদ্ধি অভিযান
সিটিটিসি ও র্যাবের অন্তত ৬ জন সিনিয়র কর্মকর্তাকে বদলি বা অপসারণ করা হয়েছে। অনেকে বলছেন,
এটি ভবিষ্যতে জঙ্গিদের পুনর্গঠনের সুযোগ করে দেবে।
ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা
অস্থায়ী সরকারের মুখপাত্ররা সাম্প্রতিক বক্তব্যে পূর্ববর্তী সব সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমকে
“রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাজানো নাটক” বলে আখ্যা দিয়েছেন। এতে সন্ত্রাসবিরোধী ঐকমত্য ভেঙে পড়ছে,
যার সুযোগ নেবে জঙ্গিরাই।
তরুণদের টার্গেট ও সামাজিক মাধ্যমে জিহাদি প্রচারণা
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ধর্মের নামে উগ্রবাদে জড়ানোর জন্য খোলাখুলি প্রচারণা
চলছে। ২৫ মে ২০২৫-এ আব্দুল্লাহ শেখ নামে এক ফেসবুক আইডি থেকে শত শত ছাত্রের মধ্যে জিহাদি
লিফলেট বিতরণের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকর্তাদের ওপর নিপীড়ন
অভিযোগ আছে, অন্তত ২০ জন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা, যারা সন্ত্রাসবিরোধী অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ,
তাদের হয় বরখাস্ত করা হয়েছে, নয়তো ভুয়া মামলায় জড়ানো হয়েছে। পূর্ববর্তী সন্ত্রাসবিরোধী
অভিযানগুলোকে “ভুয়া ও সাজানো” বলে অভিহিত করা হচ্ছে। এর ফলে ভবিষ্যতের সন্ত্রাসবিরোধী
উদ্যোগও নিরুৎসাহিত হবে।
উপসংহার
সংস্কার ও পুনর্নবীকরণের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষমতায় আসা ইউনুস প্রশাসন আসলে চরমপন্থাকে
উত্থানের সুযোগ করে দিচ্ছে। রাজনৈতিক শূন্যতায় ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সরকার হয়তো
অবহেলা, অদক্ষতা বা গোপন সহানুভূতির কারণে এটিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
যদি সময়মতো রুখে না দেওয়া হয়, তবে ইউনুসের শাসন গণতন্ত্র নয়—বরং ইসলামপন্থী শক্তির সংহতি
এনে দেবে, যার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব গোটা উপমহাদেশে পড়বে।