দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশিত স্থিতিশীল গণতন্ত্রের
পথে পদক্ষেপ নয়
বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে যখন “প্রধান উপদেষ্টা” হিসেবে সরকার
পরিচালনার দায়িত্ব নিতে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, তখন অনেকেই আশা করেছিলেন স্বাধীনতার পর
থেকে যে দোলাচলপূর্ণ স্বৈরশাসন চলছে, সেখান থেকে মুক্তির পথ তৈরি হবে। তার নেতৃত্বাধীন নতুন
সরকারে যোগ দেন তরুণ ও আপাতদৃষ্টিতে আদর্শবাদী ছাত্রনেতারা, যারা শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলের
অবসান ঘটানো আন্দোলন থেকে উঠে এসেছিলেন। অনেকে ভেবেছিলেন, ধুলা-মাটি ঝরে গেলে হয়তো
বাংলাদেশে আবার এক প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের উত্থান ঘটবে।
কিন্তু সেই আশা এক বছরেরও কম সময়ে ভেঙে যায়। গত সপ্তাহে মন্ত্রিসভা দেশের সন্ত্রাসবিরোধী
আইনের আওতায় শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এটি হতাশাজনকভাবে সেই
আচরণের প্রতিধ্বনি, যেভাবে হাসিনা বিরোধী দলকে দমন করতেন। যদিও হাসিনা কখনও তার প্রধান
প্রতিপক্ষ বিএনপিকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেননি।
এই নিষেধাজ্ঞা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর ধারাবাহিক হামলা
এবং দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগের অপব্যবহারের পরিণতি। মানবাধিকার সংগঠনগুলো
জানিয়েছে, অনেক মামলার বাদীরাই জানতেন না কার নাম আসামি হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। হাসিনার
দেশত্যাগের পর আইনের শাসন ভেঙে পড়ে এবং প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
আওয়ামী লীগের দাবি, শুধু জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের ৪০০ সদস্য নিহত হয়েছেন।
ইউনুস ও তার সরকারকে অনেক আগেই এ ধরনের সহিংসতা বন্ধে উদ্যোগ নিতে হতো। দুই প্রধান
রাজনৈতিক দলের একটিকে নিপীড়নের লক্ষ্য বানালে গণতন্ত্র গড়ে তোলা যায় না। হাসিনার সবচেয়ে বড়
ভুলও ছিল তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কারাবন্দি করার চেষ্টা।
ইতিহাসের দলকে নিষিদ্ধ করা মানেই বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করা
আওয়ামী লীগ হয়তো বর্তমানে অজনপ্রিয়, কিন্তু এখনও দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের
প্রতিনিধিত্ব করে। দলটির ইতিহাস বাংলাদেশের জন্মের চেয়েও পুরনো। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের
বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে রূপ দেওয়া এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম সংগঠিত করার প্রধান বাহন ছিল
আওয়ামী লীগ। এই দলকে নিষিদ্ধ করা মানেই বাংলাদেশকেই অস্বীকার করা।
শেখ হাসিনার শাসনামলে দলটি নিঃসন্দেহে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা পারিবারিক উত্তরাধিকার বলে মনে
হতো। (তিনি দেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা।) তবে
উপমহাদেশে এটি অস্বাভাবিক নয়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দল কংগ্রেসও গত ৮০ বছরের
বেশিরভাগ সময় নেহেরু-গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে।
কিন্তু এটি নিষিদ্ধ করার যথেষ্ট কারণ হতে পারে না, বিশেষত যখন দলটি বাংলাদেশের জন্ম ও বিকাশের
সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বরং এটি বিশ্বমহলে সেই উদ্বেগকে আরও জোরদার করেছে যে ইউনুস
সরকার ইসলামপন্থীদের ওপর অতিরিক্তভাবে নির্ভরশীল, যারা বাংলাদেশের ধর্মীয় স্বাধীনতার চরিত্র
বদলে দিতে চায়—যে স্বাধীনতার সঙ্গে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল।
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পরিবর্তে অনিশ্চয়তা
এই উদ্বেগ যদি ভিত্তিহীনও হয়, তবুও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ইউনুস সরকারের
দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। হাসিনার সরকার অন্তত ইসলামপন্থী উগ্রবাদের ভয়ে প্রণোদিত ছিল।
কিন্তু ইউনুস সরকারের উদ্দেশ্য কী, তা বোঝা কঠিন।
সত্যিকারের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এখানে মূল লক্ষ্য বলে মনে হচ্ছে না। সর্বোত্তম পরিস্থিতি হতে
পারত—ইউনুস দুই বছর ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করবেন এবং পরে একটি
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে যেখানে আওয়ামী লীগও অংশ নেবে। তারা জিতবে না হয়তো, কিন্তু
তাদের ভোটব্যাংক নতুন সরকারকে সংসদে জবাবদিহির মধ্যে রাখত।
এখন সেটি কার্যত অসম্ভব। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে এবং সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থী দলকে
বৈধতা দেওয়ার কারণে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিই বাস্তব বলে মনে হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা,
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং সংঘাতমূলক পররাষ্ট্রনীতি এখন অনেক বেশি সম্ভাব্য।
অর্থনীতি ও বিনিয়োগের জন্য বিপর্যয়
এটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক মহাবিপর্যয় হতে পারে। যারা সম্প্রতি দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে
বেরিয়ে আসা শুরু করেছিলেন, তারা আবার ঝুঁকির মুখে। দেশের উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি পোশাক
রপ্তানির জন্য প্রয়োজন স্থিতিশীল বৈদেশিক বাজার ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা। অভ্যন্তরীণ
স্থিতিশীলতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। আর সেটি না হলে পাকিস্তানের মতোই অর্থনৈতিক মন্দা ও অস্থিরতায়
দেশ নিমজ্জিত হবে।
বাংলাদেশিরা গর্ব করেন যে স্বাধীনতার পর তাদের দেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় রয়েছে।
কিন্তু এখন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তারা হয়তো সেই একই ধ্বংসের পথে হাঁটছে।