ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদে আসীন হয়েই নিজের ও নিজ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে থাকা ১,১১১ কোটি টাকার কর ফাঁকির মামলা তুলে নিয়ে নজিরবিহীন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা আদায়ের এই ঘটনাকে বিশ্লেষকরা স্বার্থের সংঘাত ও আইনের শাসনের প্রতি এক চরম উপহাস হিসেবে দেখছেন।

২০২৪ সালের ৮ই আগস্ট ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণের পরপরই ড. ইউনূস নির্বাহী আদেশে নিজের ব্যক্তিগত ৩টি এবং তার প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৩৫টিসহ মোট ৩৮টি কর ফাঁকির মামলা প্রত্যাহার করে নেন। প্রাপ্ত নথি অনুযায়ী, এই মামলাগুলোতে মোট কর ফাঁকির পরিমাণ ছিল ১,১১১ কোটি ৭ লক্ষ ৪৯ হাজার ১১২ টাকা।

নিজেকে দায়মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ

একটি নতুন সরকারের যখন দেশজুড়ে স্থিতিশীলতা ফেরানো এবং অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় মনোযোগ দেওয়ার কথা, তখন প্রধান উপদেষ্টার প্রথম পদক্ষেপই ছিল নিজেকে আইনি বিপদ থেকে মুক্ত করা। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে ১২ কোটি ৪৬ লক্ষ ৭২ হাজার ৬০৮ টাকার কর ফাঁকির মামলা চলমান ছিল। তবে সবচেয়ে বড় অভিযোগের তীর ছিল তার “গ্রামীণ ইকোসিস্টেম” নামক বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের দিকে। অভিযোগ উঠেছে, বিচারিক প্রক্রিয়ায় রায় হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে থাকা শত শত কোটি টাকার মামলা তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে ধামাচাপা দিয়েছেন।

হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকির আঁতকে ওঠার মতো চিত্র

ড. ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগগুলো ছিল পাহাড়সম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

গ্রামীণ কল্যাণ: এই একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই ৬টি মামলায় মোট ৬৭১ কোটি ১১ লক্ষ টাকার কর ফাঁকির অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে ৬৬৬ কোটি টাকার একটি মামলার রায় হওয়ার কথা ছিল ৫ আগস্ট, ২০২৪।

গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্ট: প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ২টি মামলায় ২০৯ কোটি ৯৮ লক্ষ টাকার কর ফাঁকির অভিযোগ ছিল।

গ্রামীণ শক্তি: এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও প্রায় ৪৮ কোটি ৪৩ লক্ষ টাকার কর ফাঁকির মামলা ছিল।

অন্যান্য প্রতিষ্ঠান: এছাড়াও গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ মৎস্য ও পশু সম্পদ ফাউন্ডেশন এবং গ্রামীণ টেলিকমের মতো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও কোটি কোটি টাকার কর ফাঁকির অভিযোগ ছিল।

শুধু কর মওকুফ নয়, চলছে রাষ্ট্রীয় সুবিধার মহোৎসব

কর মামলা প্রত্যাহার করেই থেমে থাকেননি ড. ইউনূস। তার বিরুদ্ধে গ্রামীণ নেটওয়ার্কের জন্য রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য আদায়ের অভিযোগও উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে:

নতুন ব্যবসার লাইসেন্স: তার প্রতিষ্ঠান “গ্রামীণ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস”-কে জনশক্তি রপ্তানির লাইসেন্স প্রদান।

আর্থিক খাতে প্রবেশ: গ্রামীণ টেলিকমকে “ডিজিটাল ওয়ালেট” পরিচালনার অনুমোদন।

শিক্ষা খাতে প্রভাব: দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা “গ্রামীণ ইউনিভার্সিটি” স্থাপনের অনুমোদন।

গ্রামীণ ব্যাংকে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ: গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের ২৫% শেয়ার কমিয়ে ১০% করা এবং ব্যাংকটির জন্য ৫ বছরের কর অব্যাহতি পুনর্বহাল করা হয়েছে।

বিচারের বাণী নীরবে কাঁদে?

বিশ্বজুড়ে শান্তির দূত হিসেবে পরিচিত একজন নোবেলজয়ীর বিরুদ্ধে নিজ দেশেই হাজার কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ নিঃসন্দেহে লজ্জাজনক। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে সেই অভিযোগ থেকে নিজেকে মুক্ত করা এবং নিজের বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যকে রাষ্ট্রীয় সম্পদে শক্তিশালী করা আইনের শাসনের প্রতি এক নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতা।

এই ঘটনা সৎ করদাতাদের সঙ্গে প্রতারণা এবং বিচার ব্যবস্থার উপর জনগণের আস্থাকে চুরমার করে দিয়েছে। জাতির সামনে আজ সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—যে ব্যক্তি নিজের আর্থিক স্বার্থ হাসিলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন, তার নেতৃত্বে দেশ ও দেশের অর্থনীতি কতটা নিরাপদ?

Share.
Leave A Reply

Translate »
Exit mobile version