এক উত্তাল সময়ে বিপজ্জনক নজির
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (আ.
লীগ) নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত জাতির রাজনৈতিক যাত্রায় এক সংকটময় অধ্যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে
শাসনব্যবস্থা নিয়ে ন্যায্য সমালোচনা থাকলেও, আওয়ামী লীগ একটি দল যা ঐতিহাসিক গুরুত্ব,
সাংবিধানিক বৈধতা এবং বৃহৎ গণভিত্তি বহন করে। তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা আসলে
সেই গণতান্ত্রিক আদর্শকেই ধ্বংস করে যা পুনরুদ্ধারের দাবিতে বিপ্লব সংঘটিত হয়। আইনি ও নৈতিক
উভয় দিক থেকেই এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা এবং
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মৌলিক নীতিকে হুমকির মুখে ফেলে।

১. আইনি ও সাংবিধানিক লঙ্ঘন
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় আইনের পরিপন্থী। বাংলাদেশের সংবিধান
রাজনৈতিক সমিতি ও অংশগ্রহণের অধিকার (অনুচ্ছেদ ৩৭, ৩৮, ৩৯) নিশ্চয়তা দেয়, যা গণতন্ত্রের
ভিত্তি। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা সরাসরি এই অধিকার ক্ষুণ্ণ করে। একইসাথে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদে (ICCPR) স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ
সুরক্ষার আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা বহন করে। এই নিষেধাজ্ঞা কেবল আইনবিরোধী নয়, বরং
বাংলাদেশের বৈশ্বিক ভাবমূর্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাছাড়া, রাজনৈতিক দল ভেঙে দেওয়ার জন্য
বিচারিক তদারকি প্রয়োজন (Political Parties Ordinance, 1978 অনুযায়ী)। কিন্তু বর্তমান নিষেধাজ্ঞা
নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়েছে, যা প্রক্রিয়াগত বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

২. গণতান্ত্রিক ও নৈতিক উদ্বেগ
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ দল। তাদের নিষিদ্ধ করা মানে কোটি কোটি নাগরিকের
রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব কেড়ে নেওয়া, যা বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। ইতিহাস
দেখায়—জনপ্রিয় দলকে নিষিদ্ধ করলে তারা মুছে যায় না, বরং গোপনে কার্যক্রম চালায়, উগ্রবাদ বৃদ্ধি
পায় এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। শাসনের নৈতিক ভিত্তি হলো—যে ব্যক্তি অপরাধ করেছে তাকে শাস্তি
দেওয়া, কিন্তু পুরো সংগঠন ও সমর্থককে শাস্তি দেওয়া অন্যায় সমষ্টিগত শাস্তি।

৩. ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা: ১৯৪৯ থেকে ১৯৭১
আওয়ামী লীগ শুধুই একটি রাজনৈতিক দল নয়—এটি বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন,

 ১৯৬৬-এর ছয় দফা,

 ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিজয়,

 ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিবনগর সরকার—

এসবই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছে। এই দল নিষিদ্ধ করা মানে বাংলাদেশের ইতিহাস মুছে
ফেলা।

৪. জাতি গঠন ও উন্নয়নে অবদান
আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬–২০০১ এবং ২০০৯–২০২৪ সময়কালে অসংখ্য অবকাঠামো ও উন্নয়নমূলক
প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে—
 পদ্মা সেতু

 মেট্রোরেল

 কর্ণফুলী টানেল

 গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন

 ডিজিটাল বাংলাদেশ উদ্যোগ

এসব প্রকল্প আন্তর্জাতিক মহল দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে। এই ধারাবাহিক উন্নয়নের নেতৃত্বদানকারী
দলকে নিষিদ্ধ করা জাতীয় অগ্রগতির ধারা ছিন্ন করবে।

৫. নৈতিকতা ও ন্যায়বিচারের প্রশ্ন
কিছু নেতার কর্মকাণ্ডের জন্য পুরো দলকে শাস্তি দেওয়া নৈতিকতার পরিপন্থী। আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগত
অপরাধের বিচার হওয়া উচিত, কিন্তু দল নিষিদ্ধ করে লাখো সমর্থককে বঞ্চিত করা প্রতিহিংসামূলক
আচরণ।

৬. আন্তর্জাতিক আইন ও গণতান্ত্রিক মানদণ্ড
ICCPR-এর অনুচ্ছেদ ২৫ অনুযায়ী নাগরিকদের রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত। একটি
বৃহৎ জনপ্রিয় দলকে নিষিদ্ধ করা সরাসরি এই চুক্তি লঙ্ঘন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে (মিসর, তুরস্ক,
পাকিস্তান) বিরোধী দল নিষিদ্ধ করার ফলে দেখা গেছে—অস্থিরতা, স্বৈরতন্ত্র, আন্তর্জাতিক
নিষেধাজ্ঞা ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভাঙন।

৭. স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের ঝুঁকি
জনপ্রিয় দলকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিলে গণবিচ্ছিন্নতা, দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা ও
স্বৈরতন্ত্রের ঝুঁকি বেড়ে যায়। আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন প্রকাশকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হলে
তা মতপ্রকাশ, সমাবেশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করবে।

৮. আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো সতর্ক করেছে—রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা গণতন্ত্রকে দুর্বল
করবে এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে। দেশে-বিদেশে এটি ব্যাপকভাবে অবৈধ ও অগ্রহণযোগ্য
হিসেবে দেখা হচ্ছে।

উপসংহার: গণতন্ত্র ধ্বংস করে তা পুনর্গঠন সম্ভব নয়
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা আইনি দিক থেকে অগ্রহণযোগ্য এবং নৈতিকভাবে অন্যায়। এটি সংবিধানের
লঙ্ঘন, বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসকে অস্বীকার, উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত এবং কোটি মানুষের রাজনৈতিক
অধিকার হরণ। ২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক অগ্রগতি চাইলে বহুদলীয় অংশগ্রহণ
ও আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। আওয়ামী লীগকে দমন করা গণতন্ত্র পুনর্গঠনের নয়, বরং
ধ্বংসের পথ।

Share.
Leave A Reply

Translate »
Exit mobile version