বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে গত ১২ মাসে ড. মুহাম্মদ ইউনূস মোট ১২টি
দেশ সফর করেছেন—যুক্তরাষ্ট্র, আজারবাইজান, মিসর, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন,
থাইল্যান্ড, কাতার, ভ্যাটিকান সিটি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়া।
যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়া সফর বাদ দিয়ে বাকি ১০টি সফরের খরচ প্রায় ২,৬০৮ কোটি টাকা (২৬ মিলিয়ন
মার্কিন ডলার)। এ সময় তিনি বিদেশে কাটিয়েছেন ৭০ দিন। কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশ এসব সফর
থেকে কী পেয়েছে?

কনফারেন্সে যোগ, ছবি তোলা, অথচ অর্জন শূন্য
ড. ইউনূসের প্রথম ১১টি সফরের বেশিরভাগই কোনো বিদেশি সরকারের আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণে নয়; বরং
আন্তর্জাতিক সংস্থার কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার জন্য। কয়েক ক্ষেত্রে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট বা
জাপানের প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে ছবি তুলেছেন। এ ধরনের সফরে সরকার-সরকারি কোনো সাফল্য আসেনি।
তবুও দেশের কিছু গণমাধ্যম ও সরকারপন্থী মহল এসব সফরকে ‘বড় কূটনৈতিক সাফল্য’ আখ্যা দেয়।
বাস্তবে এগুলো শুধুই ‘শূন্যের জমানো হিসাব’—অর্জন বা গুরুত্বহীন।

জাপান, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যে কী হলো?
অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে বলা হচ্ছে জাপানের ১.০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের
অর্থায়ন। কিন্তু এটি নতুন কোনো চুক্তি নয়; শেখ হাসিনার আমলেই অনুমোদিত প্রকল্পের ধারাবাহিকতা।
নতুন বিনিয়োগ চুক্তি হয়নি।
চীনে ৯টি সমঝোতা স্মারক (MoU) সই হয়েছে—সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও সাংবাদিকতা নিয়ে। শিল্প বা
বাজার সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশ ইআরডি (Economic Relations Division)
নিজেই বলেছে—এ ধরনের ক্ষুদ্র সমঝোতা প্রধান উপদেষ্টার উচ্চ পর্যায়ের সফরের জন্য উপযুক্ত ছিল
না।
মধ্যপ্রাচ্যে (কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত) কেবল ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের আশ্বাস মিলেছে, দৃশ্যমান
কিছু হয়নি। আমিরাতে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের প্রাথমিক আলোচনা হলেও বাস্তবায়ন
অনিশ্চিত।

যুক্তরাষ্ট্র, ভ্যাটিকান ও যুক্তরাজ্যে সফর

যুক্তরাষ্ট্রে তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেন এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো
বাইডেনের সঙ্গে ছবি তোলেন। কিন্তু নতুন কোনো বিনিয়োগ বা কূটনৈতিক সুবিধা আসেনি; বরং একই সময়ে
বাংলাদেশিদের ওপর ভিসা ও ভ্রমণ সীমাবদ্ধতা বেড়েছে।
ভ্যাটিকানে গিয়ে তিনি তাঁর “থ্রি জিরো” দর্শন প্রচার করেছেন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোনো লাভ হয়নি।
আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিলেও অনুষ্ঠানটিকে ব্যক্তিগত
প্রচারণায় রূপ দেন।
যুক্তরাজ্যে গিয়ে তিনি তথাকথিত “কিং চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড” পাওয়ার দাবি করেন। তবে রাজা তৃতীয়
চার্লসের ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে তাঁর নাম প্রাথমিকভাবে তালিকাভুক্ত ছিল না, যা পুরস্কারের বৈধতা
নিয়ে প্রশ্ন তোলে। প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি। রাজনৈতিক মহলে
জল্পনা—প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিএনপি নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ। অথচ তাঁরই প্রশাসন
তারেক রহমানের দেশে ফেরা বন্ধ করেছে। রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয়ে এ ধরনের সফরকে অনেকেই ‘রাষ্ট্রীয়
সম্পদের অপচয়’ বলছেন।

মূল প্রশ্ন: রাষ্ট্রীয় স্বার্থে, নাকি ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিং?
বাংলাদেশ যখন বৈদেশিক ঋণ শোধ, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে
ভুগছে, তখন এসব ব্যয়বহুল সফর থেকে রাষ্ট্র কোনো উল্লেখযোগ্য আর্থিক স্বস্তি পায়নি। সীমান্ত
বিরোধ, রোহিঙ্গা সমস্যা বা তিস্তা–গঙ্গা পানিবণ্টন—এসব গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতেও কোনো
অগ্রগতি হয়নি।
সব মিলিয়ে ধারণা জোরদার হচ্ছে—ড. ইউনূস বিদেশি শক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন জাতীয় স্বার্থ
ও সার্বভৌমত্বের ক্ষতির বিনিময়ে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিদেশ সফরের তালিকা
১ম সফর
২৩–২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ – নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র: জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে
অংশগ্রহণ।
২য় সফর
১১–২২ নভেম্বর ২০২৪ – বাকু, আজারবাইজান: জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন।
৩য় সফর
১৮–২০ ডিসেম্বর ২০২৪ – কায়রো, মিসর: ডি-৮ সম্মেলনে অংশগ্রহণ।
৪র্থ সফর
২১–২৫ জানুয়ারি ২০২৫ – দাভোস, সুইজারল্যান্ড: ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম।
৫ম সফর

১৩–১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ – দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত: ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিট।
৬ষ্ঠ সফর
২৬–৩০ মার্চ ২০২৫ – হাইনান ও বেইজিং, চীন: বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া, পরবর্তীতে প্রথম
দ্বিপাক্ষিক বৈঠক।
৭ম সফর
৩–৪ এপ্রিল ২০২৫ – ব্যাংকক, থাইল্যান্ড: বিমস্টেক সম্মেলন।
৮ম সফর
২১–২৫ এপ্রিল ২০২৫ – দোহা, কাতার: আর্থনা সামিটে অংশগ্রহণ।
৯ম সফর
২৬ এপ্রিল ২০২৫ – ভ্যাটিকান সিটি: পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া।
১০ম সফর
২৮ মে–১ জুন ২০২৫ – টোকিও, জাপান: নিক্কেই ফোরাম “ফিউচার অব এশিয়া”, জাপানের প্রধানমন্ত্রীর
সঙ্গে বৈঠক।
১১তম সফর
১০–১৩ জুন ২০২৫ – লন্ডন, যুক্তরাজ্য: গোপনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের জল্পনা।
১২তম সফর
১১–১৩ আগস্ট ২০২৫ – কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া: প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের আমন্ত্রণে
সরকারি সফর; পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (MoU) ও তিনটি নোট অব এক্সচেঞ্জ স্বাক্ষর।

Share.
Leave A Reply

Translate »
Exit mobile version