সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিচারবহির্ভূত হামলা ও মারধরের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় জনমনে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে দেশজুড়ে এমন ঘটনা ঘন ঘন ঘটছে। এসব ঘটনায় বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। হেনস্তার শিকার হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সাধারণ মানুষসহ অসংখ্য বিশিষ্ট ব্যক্তি।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, এই মব সন্ত্রাসে প্রায়ই আক্রান্ত ব্যক্তিরাই হয়ে যাচ্ছেন আসামি। পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা যেন প্রশ্নবিদ্ধ। হামলাকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে প্রায়ই আক্রান্ত ব্যক্তিকেই আটক করা হচ্ছে। আর তারপর তাদের নামে দেওয়া হচ্ছে হত্যা বা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অপছন্দের ব্যক্তি লক্ষ্য করে হামলা করা হচ্ছে—যার ফলে বিচারবহির্ভূত সহিংসতার ধারা আরও গতি পাচ্ছে।
মব সন্ত্রাসের প্রকৃতি
রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, দেশের মব ভায়োলেন্স যেন মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। দাবি আদায়ে কিছু ব্যক্তি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রশাসন বা প্রতিষ্ঠান প্রধানের ওপর হামলা চালাচ্ছেন।
জোর করে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করানো বা ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ আখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মারধর বা হেনস্তা করা সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে।
এই ধারা মূলত ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শুরু হয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে।স্কুল ও কলেজে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষক ও অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করছেন। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে আদালতের সামনেও সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ওপর হামলা এবং ডিম নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে।
প্রভাবিত ও আক্রান্তরা
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর দেড় শতাধিক ব্যক্তি বিভিন্ন মব হামলার শিকার হয়েছেন। উল্লেখযোগ্য কিছু
ঘটনা:
১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোবাইল চুরির অভিযোগে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক ভবঘুরে নিহত হন, এক্ষেত্রে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী জড়িত। একই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামিম আহমেদ মোল্লা নিহত হন।
২২ ডিসেম্বর, ২০২৪: কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ৭৮ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই কানুকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে মারধর করা হয়।
২৯ এপ্রিল, ২০২৫: ঢাকায় অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে রমনা থানায় পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হয়।
২২ জুন, ২০২৫: সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা ও সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে হামলার শিকার করা হয়।
৯-১১ আগস্ট, ২০২৫: রংপুর, মাদারীপুর ও গাজীপুরে চোর সন্দেহে জনতা গণপিটুনিতে হত্যা ঘটেছে।
এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সমালোচনাজনক দুটি ঘটনা
১৫ আগস্ট, ২০২৫: ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিতে গিয়েছিলেন রিকশাচালক আজিজুর রহমান। তাকে মারধর করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন তার নামে জুলাই আন্দোলনের সময় হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের হয়। জনমনে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
২৯ আগস্ট, ২০২৫: ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ‘মঞ্চ-৭১’ গোলটেবিল বৈঠকে হামলা চালানো হয়। সাবেক মন্ত্রী ও আইন বিভাগের অধ্যাপককে লাঞ্ছিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৬ জনকে আটক করে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করা হয়।
এ ঘটনাগুলি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিচারবহির্ভূত সহিংসতার ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে।
আইনের দিক থেকে মূল্যায়ন
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ অনুযায়ী, “প্রত্যেক নাগরিকেরই রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকার অধিকার রয়েছে। আইনবহির্ভূতভাবে কারও জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির প্রতি ক্ষতিকর ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।” অনুচ্ছেদ ৩৫ (৩) অনুযায়ী, ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা দ্রুত এবং স্বাধীন আদালতে বিচার পাবেন। অর্থাৎ, কাউকে বিচারবহির্ভূত শাস্তি দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। তবুও, গত এক বছরে দেখা গেছে যে আক্রান্ত ব্যক্তি নয়, হামলাকারীর চেয়ে বরং নিরীহ ব্যক্তিরাই আইনের আওতায় আসছেন।
ইউনুস এবং প্রশাসনিক দায়
রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাতীয় জননেতা ইউনুস ও তার নেতৃত্বাধীন প্রশাসন এই মব সন্ত্রাসের জড়িতদের শক্তি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ।
সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের নির্বাহী ফোরামের সীমা দত্ত বলেন, “অন্যায় সবসময়ই অন্যায়। কাউকে বৈধ, অন্যকে অবৈধ করতে অতীতকে টেনে আনা যায় না। আইনের সঠিক প্রয়োগ অপরিহার্য।”
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, “ভুক্তভোগীরাই গ্রেফতার হওয়ায় দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যাহত হচ্ছে। সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।”
বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, মব সন্ত্রাস চলতে থাকলে দেশে আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যা থেকে বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার করা এক সময় গিয়ে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।