২০২৪ সালের আগস্টে নির্বাচিত সরকারকে বিতর্কিতভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার পর নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ
ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। নির্বাচনবিহীন এই ক্ষমতা
গ্রহণকে অনেকে অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ প্রেক্ষাপটে
সংবাদমাধ্যমের প্রতি ইউনূস সরকারের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী আচরণ অপ্রত্যাশিত ছিল না।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পরিবর্তে তাঁর সরকার ভিন্নমত দমনে এবং
সংবাদমাধ্যমকে স্তব্ধ করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। নতুন আইনি অস্ত্র, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং আতঙ্কের
পরিবেশ তৈরি করে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে শ্বাসরুদ্ধ করা হচ্ছে।
সাংবাদিকদের ওপর দমনপীড়ন বৃদ্ধি
ক্ষমতায় আসার অল্প সময়ের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার দুটি বিতর্কিত অধ্যাদেশ জারি করে: সাইবার
নিরাপত্তা অধ্যাদেশ ২০২৫ এবং ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫। ডিজিটাল অধিকার সুরক্ষার
নামে আনা এই আইনগুলো বরং সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ২০২৫
সালের জানুয়ারি নাগাদ অন্তত ২১ জন সাংবাদিক গ্রেপ্তার হন, যাদের মধ্যে মাত্র তিনজন জামিন পান।
এর বাইরে শতাধিক সাংবাদিক আহত হন এবং প্রায় ৯০০ সাংবাদিক চাকরিচ্যুত বা পদত্যাগে বাধ্য হন।
মামলা ও নির্বিচার গ্রেপ্তারের ঢেউ
২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত অন্তত ২৯৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ৬০০-র
বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে, যার মধ্যে হত্যার মতো চাঞ্চল্যকর অভিযোগও রয়েছে। সিনিয়র সাংবাদিক
মুজাম্মেল বাবু ও শ্যামল দত্ত দেশত্যাগের চেষ্টা করার সময় গ্রেপ্তার হন। অধিকাংশ মামলাই
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ভিন্নমত স্তব্ধ করার কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে।
স্বীকৃতি কার্ড বাতিল
২০২৪ সালের নভেম্বরে সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট (পিআইডি) ১৬৭ জন সাংবাদিকের
স্বীকৃতি কার্ড বাতিল করে। এর ফলে তারা সরকারি দপ্তরে প্রবেশ ও আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান কভারেজ
থেকে বঞ্চিত হন।
আর্থিক হয়রানি ও নজরদারি
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) অন্তত ১৮ জন সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাব
জব্দ করে এবং আরও ৯৬ জনের আর্থিক তথ্য দাবি করে। এ ছাড়া ৮৩ জন সাংবাদিক জাতীয়
প্রেসক্লাবের সদস্যপদ হারান।
“অপারেশন ডেভিল হান্ট”
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার “অপারেশন ডেভিল হান্ট” চালু করে, যার আওতায় ১১,০০০-রও বেশি
মানুষ গ্রেপ্তার হন, এর মধ্যে বহু সাংবাদিকও ছিলেন। সমালোচকরা বলছেন, প্রকৃত হুমকিকে নয় বরং
সরকারবিরোধীদের দমন করতেই এ অভিযান পরিচালিত হয়েছে।
জনতার হুমকি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ
মিডিয়া রিফর্ম কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ স্বীকার করেছেন, গোয়েন্দা সংস্থার সরাসরি হস্তক্ষেপ
কিছুটা কমলেও “জনতার হুমকি” বেড়েছে। এর ফলে সাংবাদিকরা ব্যাপক আত্মনিয়ন্ত্রণে বাধ্য হচ্ছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটূক্তি, ঘৃণার প্রচারণা ও পেশাগত শাস্তির ভয়ে সাংবাদিকরা সত্য প্রকাশে
নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
টকশোতে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব
টেলিভিশন টকশো এখন প্রকাশ্য রাজনৈতিক আনুগত্যে বিভক্ত। অতিথি নির্বাচনে রাজনৈতিক আনুগত্য
প্রধান ভূমিকা পালন করছে। আগের আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে মনে করা
সাংবাদিকদের কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ফলে ভিন্নমতের প্রকাশের ক্ষেত্র প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে।
নজিরবিহীন দমননীতি
বাংলাদেশের ইতিহাসে এত সুসংগঠিতভাবে ভিন্নমত দমনের নজির নেই। অতীতের সামরিক বা
স্বৈরশাসনকালেও এ ধরনের দমননীতি বিরল ছিল। ২০২৫ সালের এপ্রিলে তথাকথিত “ফারুকী ঘটনা”র
পর তিন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয় এবং একটি বড় টেলিভিশন চ্যানেলকে স্তব্ধ করা
হয়—শুধুমাত্র সরকারের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টার সমালোচনা করার কারণে।
উচ্চপর্যায়ে সংবাদমাধ্যম স্তব্ধকরণ
প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয় ও অন্যান্য উপদেষ্টারা সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ
প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। সমালোচনামূলক প্রশ্ন তুলতে গিয়ে অনেক সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন—যা
অতীতের কঠোরতম শাসনকালেও দেখা যায়নি।
ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও মানসিক হয়রানি
কোনো আইনি ভিত্তি ছাড়াই অনেক সাংবাদিকের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। চাকরি
হারানো, মামলা, হুমকি ও শারীরিক আক্রমণের পাশাপাশি এটি তাদের গভীর মানসিক ট্রমা ও অনিশ্চয়তার
মধ্যে ফেলেছে।
বিটিআরসি’র ডিজিটাল সেন্সরশিপ
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সমালোচনামূলক বহু সংবাদ প্রতিবেদন সরিয়ে
ফেলেছে। এতে ডিজিটাল স্পেসে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে বিপন্ন হয়েছে।
সংকটে সংবাদপত্র
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ও আর্টিকেল ১৯ জরুরি সংস্কারের আহ্বান
জানিয়েছে। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)-এর তথ্যমতে, সাংবাদিক কারাবন্দির সংখ্যায়
বাংলাদেশ বিশ্বে ১৪তম অবস্থানে রয়েছে; বর্তমানে চারজন সাংবাদিক কারাগারে। আইন ও সালিশ
কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, শুধু ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসেই ১০২টি সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা
ঘটেছে।
রাজনৈতিক প্রতিশোধ
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও দায়ের হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর আন্দোলনে
অংশগ্রহণের অভিযোগে সাংবাদিক শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রূপাকে গ্রেপ্তার করে একটি গার্মেন্টস
শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্ত করা হয়েছে।
সাংবাদিকতার ওপর প্রভাব
এত ব্যাপক মামলা ও হয়রানির ফলে সাংবাদিকরা আতঙ্কের মধ্যে কাজ করছেন। পেশাগত নিরাপত্তা
হারিয়ে তারা সত্য প্রকাশে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এই পরিস্থিতি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ধ্বংস করছে এবং
সঠিক তথ্য উপস্থাপন বাধাগ্রস্ত করছে।
উপসংহার
ইউনূস সরকারের অধীনে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ব্যাপক
সেন্সরশিপ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা, চাকরিচ্যুতি ও মতপ্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞার ফলে
সাংবাদিকরা আজ বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ পরিবেশে কাজ করছেন। বাংলাদেশের সংবিধানের
অনুচ্ছেদ ৩৯ এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চুক্তির (ICCPR) অনুচ্ছেদ ১৯-এ
বর্ণিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে
অবিলম্বে সংবাদমাধ্যমের ওপর দমননীতি বন্ধ করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সম্মান করতে
হবে—অন্যথায় এই সময়কাল বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সংবাদমাধ্যমের জন্য এক অন্ধকার অধ্যায়
হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হবে।
✍️ ইঞ্জিনিয়ার শফিক ইসলাম (রাজনৈতিক বিশ্লেষক)