গণমাধ্যমের গলায় শিকল ও অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে মুক্ত
সাংবাদিকতার সংঘাত
২০২৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকায় অস্থায়ী সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর
এক সংবাদ সম্মেলনে দিপ্ত টিভির সিনিয়র সম্প্রচার সাংবাদিক মিজানুর রহমান ও মাহমুদ শাওন, চ্যানেল
আই-এর সিনিয়র প্রতিবেদক রফিকুল বাসার এবং এটিএন বাংলার বিশেষ সংবাদদাতা মো. ফজলে রাব্বীর
করা প্রশ্নগুলোই তাদের চাকরিচ্যুতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ছবি: ড. মুহাম্মদ ইউনুসের অনুসারীদের দ্বারা মিডিয়া অফিসে হামলা
উপদেষ্টা ফারুকী এবং কিছু মহল মনে করেন, ‘জুলাই বিদ্রোহে’ নিহত ১,৪০০ জনের তথ্য ও উৎস
সম্পর্কে প্রশ্ন করা শহীদদের প্রতি অবমাননা এবং গণহত্যা অস্বীকারের সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা
হয়েছে।
দিপ্ত টিভি কর্তৃপক্ষ মিজানুর রহমানকে চাকরিচ্যুত করেছে। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ জানায়, “অভ্যন্তরীণ
কারণে সাময়িকভাবে সংবাদ কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে।” চ্যানেল আই কর্তৃপক্ষ রফিকুল বাসারকে
অব্যাহতি দিয়ে জানায়, “একটি অভিযোগ এসেছে, আমরা তদন্ত করব। সে জন্য তাকে অব্যাহতি দেওয়া
হয়েছে। এটি একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া।” এটিএন নিউজ কর্তৃপক্ষ ফজলে রাব্বীকে চাকরিচ্যুত করে
জানায়, “রিপোর্টিং চলাকালীন পেশাদারিত্বের অভাব ছিল।”
এ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা ফারুকী তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, তিনি বা সরকার কারও চাকরিচ্যুতিতে সরাসরি
বা পরোক্ষভাবে জড়িত নন। তিনি বলেন, “সাংবাদিকরা আমাকে প্রশ্ন করার জন্য চাকরি হারিয়েছে—এটি
হাস্যকর। বিষয়টি আমি নই, বিষয়টি হলো জুলাই এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নীতি।”
বাংলাদেশের অনেক সিনিয়র সাংবাদিক এই ঘটনাকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছেন।
তারা মনে করেন, সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার অধিকার এভাবে খর্ব করা হলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন প্রশ্ন উঠবে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে
নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ
করে। অস্থায়ী সরকারের শাসনামলে (আগস্ট ২০২৪ – এপ্রিল ২০২৫) সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের
বিরুদ্ধে ব্যাপক নির্যাতন, চাকরিচ্যুতি এবং পেশাগত অধিকার হরণের ঘটনা ঘটে। এ সময় অন্তত ১,৬০০
সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী চাকরি হারান, যা বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে নজিরবিহীন ঘটনা। এতে
স্বাধীন সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হয় এবং হাজারো পরিবার আর্থিক সংকটে পড়ে।

১. সাংবাদিক/গণমাধ্যমকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও হয়রানি
দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় ৭৭ জন সাংবাদিককে হত্যা, হত্যাচেষ্টা,
অবৈধ সমাবেশ ও দাঙ্গার অভিযোগে ১৯ মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। চট্টগ্রামে ৩৩ জন সাংবাদিককে
হত্যা চেষ্টা ও অপহরণের অভিযোগে ২ মামলায়, বগুড়ায় ২২ জন সাংবাদিককে হত্যা মামলায় ৮ মামলায়

এবং রাজশাহীতে ১৪ জন সাংবাদিককে ভাঙচুর, চাঁদাবাজি ও হামলার অভিযোগে ৩ মামলায় আসামি করা
হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত অন্তত ১৪০ জন
সাংবাদিক আন্দোলন সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন।

২. ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় হামলা ও দখল
২০২৪ সালের আগস্টে একাধিক টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র কার্যালয়ে হামলা চালানো হয় এবং সেগুলো
দখল করা হয়। এটিএন বাংলা ও এটিএন নিউজের অফিস লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়, ফলে কর্তৃপক্ষ
সম্প্রচার বন্ধ করতে বাধ্য হয়। একইভাবে একাত্তর টিভি, ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি, সময় টিভি ও গানবাংলা
টিভির কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়।
১৮ আগস্ট ২০২৪ সালে ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের কমপাউন্ডে অবস্থিত কালের কণ্ঠ ও রেডিও
ক্যাপিটাল অফিসে হামলা হয়। প্রায় ২৫টি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রথম আলোকে ‘ইসলামবিরোধী ও ভারতপন্থী প্রচারণা’ চালানোর অভিযোগ তুলে ২৪ নভেম্বর ২০২৪ সালে
‘বাংলার মানুষ’ ব্যানারে কিছু ইসলামপন্থী কর্মী প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে গরু জবাই করে খিচুড়ি
রান্না শুরু করে। পুলিশ বারবার অনুরোধ করলেও তারা সরে যায়নি। পরে পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস ও
সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে ছত্রভঙ্গ করে। সেনাবাহিনীও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
২৫ নভেম্বর রাজশাহীতে প্রায় ২০০ বিক্ষোভকারী প্রথম আলো অফিসে হামলা চালায়। তারা অফিসের
সাইনবোর্ড ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। একই মাসে বগুড়ার জলেশ্বরীতলা এলাকায় ১৫-১৬ জন
মুখোশধারী মোটরসাইকেল আরোহী প্রথম আলো অফিসে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এর ফলে জানালা ভেঙে
যায় ও কর্মীরা হুমকি ও অপমানের শিকার হন।

৩. প্রেস ক্লাবে হামলা ও সাংবাদিক হয়রানি
৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রেস ক্লাবে হামলা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য
কয়েকটি হলো:
 ১১ আগস্ট ২০২৪: বাংলাদেশ জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফারিদা ইয়াসমিন ও সাধারণ সম্পাদক
শ্যামল দত্তের কক্ষ দখল ও ভাঙচুর।

 ১৮ আগস্ট ২০২৪: বিএনপি নেতা এটিএম আকরাম হোসেন তালিমের নেতৃত্বে বাগেরহাট
প্রেসক্লাবে হামলা।

 ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪: রাত ১০টায় খুলনা প্রেসক্লাবে ব্যাপক ভাঙচুর, সাংবাদিক শফিকুল আলম
গুরুতর আহত।

 ৫ অক্টোবর ২০২৪: রাত ৯টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আগুন লাগানোর চেষ্টা, সাংবাদিক রাজীব
দাস হামলার শিকার।

 ১৫ নভেম্বর ২০২৪: বরিশাল প্রেসক্লাবে লাঠিসোঁটা দিয়ে হামলা, সাংবাদিক তামান্না সুলতানা
আহত।

 ২২ জানুয়ারি ২০২৫: সিলেট প্রেসক্লাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হানা, সাংবাদিক এমদাদুল হক
আপুকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়।

 ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: রংপুর প্রেসক্লাবে হামলা, সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম আহত।

 মার্চ ২০২৫: ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে হামলা, সাংবাদিক হাসান মাহমুদকে মারধর।

 ২ এপ্রিল ২০২৫: কুমিল্লা প্রেসক্লাবের প্রধান ফটকে আগুন ধরানোর চেষ্টা।

অস্থায়ী সরকারের সময়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) ৩৩ জন সাংবাদিকের
ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছিল।

৪. সাংবাদিক/গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরিচ্যুতি ও হুমকি
এ সময় অন্তত ১,৬০০ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী চাকরি হারান।
 আগস্ট ২০২৪: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ সময় টিভির
মালিকদের ১০ সাংবাদিককে বরখাস্তের দাবি করেন। পরবর্তীতে ৫ সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা
হয়।

 ১৩ আগস্ট ২০২৪: নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা প্রেসক্লাব সভাপতি মোনিরুজ্জামান মোনিরকে
গুলি করা হয়।

 চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী তলাত মাহমুদ রাফি সাংবাদিকদের সরাসরি হত্যার
হুমকি দেন।

৫. সংখ্যালঘু/হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের সংবাদ পরিবেশনে
বাধা
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে বহু সাংবাদিক মামলা, চাকরিচ্যুতি ও
প্রাণনাশের হুমকির শিকার হন। যেমন—
 আগস্ট ২০২৪: এখন টিভির সাংবাদিক ইমন চৌধুরী বরখাস্ত।

 সেপ্টেম্বর ২০২৪: সাংবাদিক সুমি বিশ্বাস মামলা ও মৃত্যুর হুমকির মুখে দেশত্যাগ করেন।

 এবিনিউজ২৪ সম্পাদক সুবাস সিনহা রায়ের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা।

 খুলনার সাংবাদিক রাহুল চন্দ্র দাস চাকরি হারিয়ে ভারতে পালিয়ে যান।

 চ্যানেল ২৪-এর মীনাক্ষী রায় চাকরিচ্যুত ও লুকিয়ে আছেন।

 জামুনা টিভির গৌতম সাহার বাড়িতে হামলা।

 মানবজমিনের রবি নাথ হুমকি ও মামলায় আত্মগোপনে।

 ইত্তেফাকের দেবাশীষ পাল-এর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা।

 ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির পূর্ণেন্দু সরকারকে বদলি।

 বিডিনিউজ২৪-এর তন্ময় বিশ্বাস গোপনে চলে যান।

 আমাদের অর্থনীতি সম্পাদক নাসিমা খান মন্টির বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা।

 আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকর্মী জুলফিকার আলী মানিক রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত।

৬. প্রেস স্বীকৃতি বাতিল

২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে তথ্য অধিদপ্তর (PID) তিন দফায় ১৬৭ জন সাংবাদিকের
প্রেস স্বীকৃতি বাতিল করে। ফলে তাদের সরকারি ভবনে প্রবেশ ও সরকারি অনুষ্ঠান কাভার করা সীমিত
হয়ে যায়।

৭. গণমাধ্যমে মালিকানা/নেতৃত্ব পরিবর্তন
অস্থায়ী সরকারের আমলে ২৯টি সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলের নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়। এভাবে
বিএনপি ও জামায়াতপন্থী সাংবাদিকদের বিভিন্ন পদে বসানো হয়।

৮. অস্থায়ী সরকারের প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে বর্তমান পর্যন্ত অস্থায়ী সরকার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার, হামলা
ও হয়রানি বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। যদিও সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি
দিয়েছে, বাস্তবে মামলার ধারা, গ্রেপ্তার ও হামলা অব্যাহত রয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (ASK) এবং সম্পাদক পরিষদ এই পরিস্থিতিকে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য হুমকি
বলে উল্লেখ করেছে। সম্পাদক পরিষদ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়েরকে ‘আইনের অপব্যবহার’
এবং সরকারের প্রতিশ্রুতির লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
অস্থায়ী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস স্বীকার করেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা
মামলা “তড়িঘড়ি করে পুরনো আইন ও প্রথার ভিত্তিতে করা হয়েছে।”

৯. আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, সাংবাদিক সংগঠন এবং বৈশ্বিক গণমাধ্যম বাংলাদেশে সাংবাদিকদের
ওপর দমন-পীড়নের ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
 অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল উদ্বেগ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের হয়রানি ও গ্রেপ্তার বন্ধের
আহ্বান জানায়।

 রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (RSF) জানায়, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ
হয়েছে।

 কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (CPJ) সাংবাদিক গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
জানায়।

 আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যেমন বিবিসি, আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান ও ডয়চে ভেলে এ বিষয়ে
ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

তাদের বক্তব্য, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত না হলে বাংলাদেশের
গণতান্ত্রিক কাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

Share.
Leave A Reply

Translate »
Exit mobile version